কালিবাউস মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন :
ভূমিকা : কালিবাউস মাছ দেখতে অনেকটা রুই মাছের মত। এর দুই জোড়া গোঁফ আছে। কালিবাউস মাছ পুকুরের তলদেশে বসবাস করে। এরা শিকারি মাছের মত আচরণ করে এবং পুকুরের/ট্যাংকের তলদেশ পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে থাকে কালিবাউস খুবই সুস্বদু মাছ বিধায় বাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে কালক্রমে মাছটির প্রাপ্রতা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মাছটির সফল কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কৃত্রিম প্রজনন কৌশল :
প্রজননক্ষম কালিবাউস মাছ সংগ্রহ : সাধারণত কালিবাউস মাছ ৩য় বছরে প্রজননের জন্য পরিপক্ক হয়ে থাকে। কৃত্রিম প্রজননের জন্য নদী উৎস (হালদা/যমুনা/ব্রহ্মপুত্র) বা ব্রুড পুকুর থেকে প্রজননক্ষম মাছ সংগ্রহ করা হয়। মাছের নিম্নলিখিত বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখে প্রণোদিত প্রজননের জন্য পরিপক্ক ব্রুড মাছ নির্বাচন করা যায় ।
চাষ পদ্ধতি :
পুকুর নির্বাচন : বাণিজ্যিক মাছ চাষের জন্য অপেক্ষাকৃত বড় আকারের পুকুর, ৪০ শতাংশ বা তদূর্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। পানির গভীরতা ৪ থেকে ৬ ফুটের মধ্যে হলে ভাল হয়। মাটি দোআঁশ বা এঁটেল দোআঁশ এবং পুকুরটি আয়তাকার হওয়া উত্তম।
* পাড় ও তলদেশ: পাড়ে ঝোপ-ঝাড় থাকলে পরিষ্কার করতে হবে। পানিতে যথেষ্ট পরিমাণে (কমপক্ষে দৈনিক ৮ ঘন্টা) সূর্যালোক প্রবেশের সুবিধার্থে সম্ভব হলে বড় গাছ কেটে ফেলতে হবে। সম্ভব না হলে অন্তত ভেতর দিকের ডাল-পালা কেটে ফেলতে হবে প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশন করে পুকুরের পাড় মেরামত ও তলদেশ অতিরিক্ত কর্মমুক্ত করে সমান করতে হবে। অন্যথায় পুকুরের পানির গুণাগুণ দ্রুত খারাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া, তলদেশ সমান না হলে পরবর্তীতে মাছ আহরণ করা কঠিন হবে।
* জলজ আগাছা ও অবাঞ্চিত মাছসহ রাক্ষুসে মাছ দুরীকরণ: যদি পানি প্রাপ্তি বিশেষ সমস্যা না হয় তাহলে পুকুরের পানি নিষ্কাশন করে সব জলজ আগাছা এবং অবাঞ্চিত মাছসহ রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করা যেতে পারে। পানি প্রাপ্তি সমস্যা হলে, প্রথমে পুকুরে বারবার জাল টেনে যতদূর সম্ভব সকল মাছ ধরে ফেলতে হবে। এরপর অবশিষ্ট সব মাছ ধরে ফেলার জন্য প্রতিশতক আয়তন ও প্রতিফুট পানির গড় গভীরতার জন্য ২৫-৩০ গ্রাম হারে রোটেনন প্রয়োগ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ৪ ফুট পানির গড় গভীরতার এক একর পুকুরে ১০-১২ কেজি রোটেনন লাগবে।
* চুন প্রয়োগ: রোটেনন প্রয়োগ করা হয়ে থাকলে প্রয়োগর ২/১ দিন পর প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। এই হারে এক একর জলায়তন বিশিষ্ট পুকুরের জন্য চুন লাগবে ১০০ কেজি।
পুরুষ কালিবাউস | স্ত্রী কালিবাউস |
---|---|
• বক্ষ পাখনার তলদেশ খসখসে থাকবে। | • পেট অধিক স্ফীত, নরম ও তুলতুলে থাকবে। |
• জননেন্দ্রিয় সাধারণত সাদাটে হয় এবং সামান্য ভিতরে ঢুকানো থাকে। | • জননছিদ্র ঈষৎ ফোলা ও বড় থাকবে এবং লালচে বা গােলাপী বর্ণ ধারণ করবে। |
• জনন ছিদ্রের কাছে হালকা চাপ দিলে সাদা তরল ঘন শুক্র বের হবে। সুপরিপক্ক মাছের শুক্র বেশ ঘন হয়। | • পেটে চাপ দিলে ডেবে যাবে, চাপ সরালে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে। পরিপক্ক মাছের ডিম্বাশয় পুরু হয়ে জননছিদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। |
• সকালের দিকে বেড় জাল টেনে পরিপক্ক প্রজননক্ষম স্ত্রী ও পুরুষ মাছ উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যাবলী দ্বারা নির্বাচন করে ধরতে হবে। • নির্বাচিত স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে আলাদা বিশ্রাম ট্যাংকে ৫-৬ ঘন্টা ধরে নিরবিচ্ছিন্ন পুকুরের পানি সরবরাহে রাখতে হবে। এতে মাছের পেট থেকে মল এবং অতিরিক্ত খাদ্য বমি করে বের করে দিয়ে মাছগুলো শক্তিশালী এবং চঞ্চল হবে। সেই সাথে হ্যাচারী পানির সাথে ট্যাংকে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। • একটি স্ত্রী মাছের জন্য দেড় থেকে দুইটি পুরুষ মাছ ধরতে হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে যে ব্রুড মাছ যেন কোনক্রমেই আঘাত প্রাপ্ত না হয়। আঘাত প্রাপ্ত মাছ প্রজননে ভালো ফল দেয় না বা প্রজনন করে না। হরমোন প্রয়োগ : কন্ডিশনিং শেষে স্ত্রী মাছকে ১ম হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয়। মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য বাজারে বিভিন্ন ধরনের সিনথেটিক হরমোন প্রচলিত থাকলেও পিটুইটারী গ্ল্যান্ড (পিজি) ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো এবং নিরাপদ। কালিবাউস মাছ সাধারণত প্রাকৃতিক পরিবেশে এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রজনন করে থাকে। কৃত্রিম প্রজননের জন্য এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসে স্ত্রী মাছকে শরীরের ওজনের ২ মি.গ্রা/কেজি ১ম হরমোন ডোজ হিসেবে পিজি প্রয়োগ করা হয়। প্রথম হরমোন ডোজ এর ৬ ঘন্টা পর স্ত্রী মাছকে ৬ মি.গ্রা/কেজি হিসাবে ২য় হরমোন ডোজ দেয়া হয়। স্ত্রী মাছকে ২য় ইনজেকশন দেওয়ার সময় পুরুষ মাছকে শরীরের ওজনের ২ মি.গ্রা/কেজি হিসেবে একটি মাত্র হরমোন ডোজ প্রয়োগ করা হয়। প্রজননের মাস এবং মাছের বাহ্যিক পরিপক্কতার ভিত্তিতে হরমোন ডোজর কিছুটা তারতম্য হতে পারে।
সারণি-১ : মাসভিত্তিক কালিবাউস মাছের পিজি প্রয়োগর মাত্রা |
---|
মাস | ১ম ডোজ (মিগ্রী./কেজি) |
ব্যবধান (ঘন্টা) | ২য় ডোজ (মিগ্রা./কেজি) |
ওভোলেশন (ঘন্টা) |
---|---|---|---|---|
এপ্রিল-মে | ২ | ৬ | ৫.৫ | ৫-৬ |
জুন-জুলাই | ১ | ৬ | ৫ | ৫-৬ |
আগস্ট-সেপ্টেম্বর | ২ | ৬ | ৬ | ৫-৬ |
ওভোলেশন ও নিষিক্তকরণ (স্ট্রিপিং পদ্ধতিতে প্রজনন) : দ্বিতীয় ইনজেকশনের পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছগুলাকে আলাদা আলাদা ট্যাংকে রাখা হয়। দ্বিতীয় ইনজেকশনের ৫-৬ ঘন্টার মধ্যে স্ত্রী মাছের ওভোলেশন (স্ত্রী মাছের ডিম ডিম্বাশয়ের ভিতরে আলাদা আলাদা হয়ে পেট নরম হওয়া এবং চাপ দেয়ার পর তরল ফুইডের সাথে ডিম জননছিদ্র দিয়ে সহজেই বের হওয়ার অবস্থাকে ওভোলেশন বলা হয়) শুরু হয়। দ্বিতীয় ইনজেকশনের ৪ ঘন্টা পর থেকে স্ত্রী মাছ স্ট্রিপিং এর জন্য প্রস্তুত হয়েছে কিনা পর্যবেক্ষণ করা হয় । ঠিকমতো ওভোলেশন হলে ডান হাত দিয়ে সামনে থেকে পিছন দিকে চেপে ডিম বের করে প্লাস্টিকের গামলায় নেয়া হয়। একই ভাবে পুরুষ মাছ থেকেও দ্রুততার সাথে কয়েক ফোঁটা শুক্র বের করে নিয়ে ডিমের উপর ছড়িয়ে দিয়ে পাখির পালক দিয়ে নাড়াচাড়া করে ডিম ও শুক্রানু প্রায় ১ মিনিট সময় ধরে ভালোভাবে মিশানো হয় । ১০-৬০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যেই ডিম ও শুক্রানু মিলিত হয়ে ডিম নিষিক্ত হয়। নিষিক্ত ডিমের সাথে পানি মিশিয়ে কয়েকবার পানি পরিবর্তন করা হয়। ফলে মিশ্রিত রক্ত, ফুইড, ডিম্বাশয়ের মেমব্রেন এবং অতিরিক্ত শুক্রানু পানির সাথে চলে যায়। অতঃপর গামলার নিষিক্ত ডিমগুলো ইনকিউবেশনের জন্য ইনকিউবেশন সার্কুলার ট্যাংকে অথবা হ্যাচিং জারে দেয়া হয় । সেখানে ডিমগুলো পানির সংস্পর্শে এসে স্ফীত হয়ে নির্দিষ্ট আকার আকৃতির পরিবর্তন করে ৪0 গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে পানি শক্ত হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পরে ফুটে মাছের রেণু বের হয় । নিষিক্ত ডিম ফুটানোর জন্য হ্যাচিং জার ও ইনকিউবেশন সার্কুলার ট্যাংক ব্যবহৃত হয়।
হ্যাকিং জাৱে ডিম ফুটানোর কৌশল:
নিষিক্ত ডিম ফুটানোর জন্য হ্যাচিং জারে অনবরত পানি প্রবাহ রাখতে হবে । হ্যাচিং জারে নিষিক্ত ডিম দেয়ার প্রথম ১-২ ঘন্টা প্রতি মিনিটে যাতে ১২-১৫ লিটার পানি নির্গমন পথ দিয়ে বের হয় এমন ভাবে পানির প্রবাহ রাখতে হবে। অধিক পানি প্রবাহে ডিমের সাথে সময় ময়লা, রক্ত ফলিকল ধুয়ে মুছে চলে যাবে অথবা ফিল্টারে আটকা পড়বে। এরপর ২৭-৩০* সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিষিক্ত হওয়ার ১৬-২৪ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে রেণু বের হয়। ডিম ফুটে পোনা বের হওয়া শুরু করলে পানির প্রবাহ বাড়িয়ে প্রতি মিনিটে আবার ১২-১৫ লিটার করতে হবে। কারণ পোনা বের হওয়া শুরু করলে ডিমের খোসা ও কিছু এনজাইমের সৃষ্টি হয় যা পানির গুণাগুণ নষ্ট করে গন্ধ বের হতে পারে। পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করার ফলে সহজেই তা ধুইয়ে বাইরে চলে যায় অথবা কাপড়ের ফিল্টারে আটকা পড়ে, যার মাঝে মাঝে ফিল্টার পরিষ্কার করে দিতে হবে । ডিম ফুটে রেণু বের হওয়া শেষ হলে আবারও পানির প্রবাহ মিনিটে ৮-১০ লিটার রেখে পোনাগুলোকে সেখানেই ৩০-৪৮ ঘন্টা সময় রাখতে হবে। তারপর হাপায় নামিয়ে প্রথম ফিডিং দিতে হবে।
ইনকিউবেশন সার্কুলার ট্যাংকে ডিম ফুটানোর কৌশল :
নিষিক্ত ডিম ফুটানোর জন্য সার্কুলার ট্যাংক ব্যবহার করা হলে তলার হাঁসকলগুলোর মাধ্যমে পানির প্রবাহ এমনভাবে নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে, যাতে ট্যাংকের তলায় কোথাও ডিম না জমে থাকে। ডিম ফুটা শুরু হলে পানির প্রবাহ সামান্য বাড়িয়ে ডিম পোনার নিচে জমে যাওয়া রোধ করতে হবে। নতুবা নিচে জমে যাওয়া পোনাগুলো বাঁচানো যাবে না। এভাবে কিছু পোনা মরে গিয়ে গন্ধ বের হলে সম্পূর্ণ ট্যাংকের সকল পোনাই আর বাঁচানো সম্বব হবে না। এজন্য নিচে জমে যাওয়া রোধ করার ব্যাপারে বিশেষ সর্তক থাকতে হবে। ডিম ফুটে বের হওয়ার ৪০-৫০ ঘন্টা পর উপরের ঝর্ণাগুলো চালাতে হবে। অত:পর ফিডিং এবং বিক্রি এই ট্যাংক থেকেই করতে হবে। বড় বড় হ্যাচারিতে বেশি পরিমাণ রেণু উৎপাদনের জন্য ইনকিউবেশন সার্কুলার ট্যাংকে ডিম ফুটানো হয়। একই জাতের বেশি রেণু উৎপাদনের জন্য সার্কুলার ট্যাংক সুবিধাজনক। এছাড়া একই ট্যাংকের মাধ্যমে প্রজনন, ইনকিউবেশন এবং রেনুর পরিচর্যা করা যায় । ৯ ফুট ব্যাসের একটি সার্কুলার ট্যাংকে ১৫-২০ কেজি রেণু উৎপাদন করা যায়। সার্কুলার ট্যাংকে তুলনামুলক ভাবে পানি খরচ বেশি এবং প্রাথমিক বিনিয়োগ ও বেশি প্রয়োজন।
ডিম পোনার পরিচর্যা :
ডিম ফুটার পর পোনার পেটে বা উদরে একটি খাদ্য থলি থাকে যা থেকে প্রায় ৬০-৭২ ঘন্টা পর্যন্ত নিজেদের খাদ্যের যোগান পেতে থাকে। যতক্ষন পর্যন্ত পোনার খাদ্য থলি থাকে ততক্ষন পোনার বাইরের খাদ্যের প্রয়াজন হয় না। এই পর্যয়ের পোনাকে ডিমপোনা বলে । ৬০-৭২ ঘন্টা পর রেণুর খাদ্য থলির সংরক্ষিত খাদ্য শেষ হওয়ার মাধ্যমে খাদ্য থলির বিলুপ্তি ঘটে। খাদ্য থলি বিলুপ্তির সাথে সাথে বাহির থেকে পোনাকে প্রথম খাদ্য হিসাবে সাধারণত সিদ্ধ ডিমের কুসুম তরল করে সরবরাহ করা হয়। এই পর্যায়ের পোনাকে রেণু পোনা বলে। রেণু পোনাকে ৬ ঘন্টা পর পর ১-১.৫ কেজি রেণু পোনার জন্য একটি ডিমের কুসুম সরবরাহ করলেই চলবে। ডিমের কুসুমকে জর্জেটের কাপড়ে ভেঙ্গে নিয়ে একটি গামলায় নীল গুলানোর মতো তরল করে নিতে হয়। অত:পর উল্লিখিত হিসেবে ডিমের তরল কুসুম ট্যাংকে বা হাপায় ছিটিয়ে ছিটিয়ে রেণুকে খাওয়াতে হবে। ডিম ফুটা শুরু হওয়ার ৬০ ঘন্টা পর প্রথম ফিডিং দিতে হবে। এভাবে ২-৩ টি ফিডিং দিয়ে রেণু পোনা বিক্রি করা বা নাসরি পুকুরে স্থানান্তর করা যায় । রেণু পরিবহনের জন্য প্যাকিং করার কমপক্ষে ৩ ঘন্টা পূর্বে রেণুকে খাবার খাওয়াতে হবে ।
প্রজননকারী মাছের পরিচর্যা।
প্রজননকারী স্ত্রী ও পুরুষ মাছগুলোকে ०.৫-১.০ পিপিএম পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট দ্রবণে গোসল করিয়ে তারপর পুকুরে ছেড়ে দেয়া হয়। স্ট্রিপিং করা মাছগুলোকে আলাদা একটি চৌকোনাকার ট্যাংকে অধিক শাওয়ারে রেখে দেয়া হয়। স্ট্রিপিং করা শেষ হলে বাছাই করে পুরুষ মাছগুলোকে ০.৫-১.০ পিপিএম ঘনত্বের পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট দ্রবণে গোসল করিয়ে এবং স্ত্রী মাছগুলোকে ২-৩ মি.গ্রা./কেজি দেহ ওজনে রেনামাইসিন ইনজেকশন দিয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে।
কালিবাউস মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনা :
উন্নত নার্সারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুস্থ ও সবল ধনী এবং চাষযোগ্য আঙ্গলী পোনা উৎপাদন করা যায়। নাসারি ব্যবস্থাপনার ধাপগুলি নিমরুপ :
নার্সারি পুকুর মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা :
সাধারণত নার্সারি পুকুরে ৪-৫ দিন বয়সের রেণু মজুদ করা হয়। জানাগুনা উন্নত জাতের রেণু উৎপাদনকারি খামার থেকে রেণু সংগ্রহ করা উচিত।
রেণু পোনা পরিবহন, পরিবেশীকরণ ও পুকুরে অবমুক্তকরণ :
• রেণু পোনা প্যাকিং করার ৩ ঘন্টা পূর্বে কৃত্রিম খাবার বন্ধ করা উচিত এবং ধানী পোনা পরিবহণের ১২-১৬ ঘন্টা পূর্বে সীমিত জায়গায় অভূক্ত অবস্থায় রাখতে হবে।
• পরিবহনের দূরত্ব, পরিবহন পাত্রের আকার, মাছের আকার এবং পোনার পরিমান বিশেষ বিবেচ্য বিষয়। একটি পরিবহন পাত্রে (৬৫ x ৪৫ সেমি.) ১২-১৮ ঘন্টা পর্যন্ত ১২৫ গ্রাম রেণু পোনা পরিবহন করা যায়।
• পলিথিন ব্যাগে এমনভাবে পানি ভর্তি করতে হবে যাতে করে ব্যাগের চারভাগের এক ভাগ পানি এবং তিন ভাগ অক্সিজেন থাকে।
• পরিবহনের সময় পলিথিন ব্যাগ খোঁচা লেগে ছিদ্র হয়ে যেতে পারে তাই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য চটের ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে ।
• প্রথমে ব্যাগ ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা সমতায় এনে রেণু পোনা ছাড়তে হবে। এর জন্য রেণু পোনা পরিবহনকৃত পলিথিন ব্যাগটি ২০-৩০ মিনিট পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে রাখতে হবে। পরে ব্যাগের মুখ আস্তে আস্তে খুলতে হবে।
• তারপর হাত একবার ব্যাগের পানিতে আবার পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে তাপমাত্রা সমান আছে কিনা দেখতে হবে । তাপমাত্রা পরীক্ষার জন্য থার্মোমিটার ও ব্যাবহার করা যেতে পারে।
• ব্যাগের পানি ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা সমতায় আনার জন্য আস্তে আস্তে পুকুরের পানি ব্যাগে দিতে হবে। এভাবে তাপমাত্রার ব্যবধান ধীরে ধীরে কমে আসবে।
• এভাবে তাপমাত্রা সমতায় আসলে ব্যাগ কাত করে হালকা ঢেউ দিলে ব্যাগ থেকে
স্বেচ্ছায় রেণু পোনা ধীরে ধীরে পুকুরে চলে যাবে। রেণু পোনা পাড়ের কাছাকাছি
সারা পুকুরেই ছাড়তে হবে।
রেণু পোনা মজুদকরণ :
* সকালে বা বিকালে যখন পানির তাপমাত্রা কম থাকে তখনই রেণু ছাড়ার উত্তম
সময়।
* কালিবাউস মাছের প্রতি কেজি রেণুতে ৪ লক্ষ মাছ থাকে। এক ধাপ পদ্বতিতে শতাংশে ৫-১০ গ্রাম এবং ২ ধাপ পদ্ধতিতে ৫০-৮০ গ্রাম রেণু মজুদ করা যায় । উল্লেখ্য যে, ২ ধাপ পদ্বতিতে রেণু উৎপাদনে অবশ্যই মজুদের ২০-২৫ দিন পর ধানী পোনা অন্য পুকুরে শতাংশে ৩০০০-8০০০ টি ধানী মজুদ করতে হবে।
রেণুর পুকুরে খাদ্য ব্যবস্থাপনা :
অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ করলে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপশি সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন। সহজ প্রাপ্য ও আর্থিক বিবেচনায় সরিষার খৈল, মিহি চালের কুড়া ও গমের ভূষি রেণুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে ।
ধানী পোনা কাটাই/অন্য পুকুরে স্থানান্তর :
রেণু পোনা বড় হয়ে ধানের আকার বা ১-২.৫ সে.মি. আকারের হলে তাদেরকে ধানী পোনা বলে। নিয়মিত সার ও খাবার দিলে ১৫-২০ দিনের মধ্যে ধানী পোনা কাটাই বা স্থানান্তরের উপযোগী হয়। তখন এদের আকার ১.৫-২.৫ সেমি, এবং ওজন ১-২ গ্রাম হতে পারে। এ সময় ধানী পোনার ঘনত্ব কমিয়ে কাটাই/পাতলা করে অন্য পুকুরে স্থানান্তরিত করতে হবে। কারন ধানী পোনা অতিরিক্ত ঘনত্বে থাকলে খাদ্য ও জায়গা নিয়ে প্রতিযোগিতা হবে। ফলে পোনা মারাও যেতে পারে। এভাবে ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ২ ধাপ নার্সারিতে ১ একর আয়তন পুকুর থেকে ৩-৪ মাসের মধ্যে ৩-৪ ইঞ্চি আকারের ৪,০০,০০০-৫,০০,০০০টি আঙ্গুলী পোনা পাওয়া যায়।
কালিবাউস মাছের চাষ পদ্ধতি :
আমাদের দেশে কালিবাউস মাছ সাধারনত মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে বটম ফিডার হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। কালিবাউস মাছের একক চাষ আমাদের দেশে খুব একটা করা হয় না। তবে অদূর ভবিষ্যতে একক চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। রুই জাতীয় মাছের মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে সাধারণত মূল মজুদের সর্বাধিক ১০-১৫% পর্যন্ত কালিবাউস এর আঙ্গুলী পোনা মজুদ করা হয়ে থাকে। রুই জাতীয় মাছের মিশ্র চাষে বছরে (৮-১২ মাসে) কালিবাউস মাছ ৫০০-৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় করণীয়
* সংরক্ষিত পিলেট খাদ্য এক মাসের মধ্যে ব্যবহার করে ফেলা উচিৎ। তবে খাদ্যে এন্টি ফাংগাল এজেন্ট/এন্টি-অক্সিডেন্ট ব্যবহার করলে উপযুক্ত পরিবেশে তা ৩-৪ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
* পোনা মজুদের পর প্রতিদিন সকাল-বিকাল মাছের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মেঘলা দিনে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
* পুকুরের পানি কমে গেলে ভাল উৎস হতে পানি সরবরাহ করতে হবে। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে পুকুরের পানি বেড়ে গিয়ে উপচে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে পানি বের করে দিতে হবে।
* সেকি ডিজে পানির স্বচ্ছতা ৮ সেন্টিমিটারের নীচে নেমে গেলে খাবার দেয়া বন্ধ থাকবে।
* পানিতে অক্সিজেনের অভাবে মাছ পানির উপরের স্তরে উঠে খাবি খেতে থাকে। এই অবস্থায় পানিতে ঢেউ সৃষ্টি করে/প্যাডেল হুইল বা এ্যারেটর ব্যবহার করে বা অন্য কোন উপায়ে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
*পুকুরের তলায় যাতে বিষাক্ত গ্যাস জমতে না পারে সেজন্য মাঝে মাঝে হররা টানতে হবে।
* জাল টেনে মাঝে মাঝে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
* বিক্রির উপযোগী মাছ ধরে ফেলতে হবে যেন অপেক্ষাকৃত ছোট মাইগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পায়।
* ফেব্রুয়ারী-মার্চে মজুদ করে ডিসেম্বরের মধ্যেই সব মাছ ধরে ফেলতে হবে।
* বাজার চাহিদার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করা প্রয়োজন।
* ভোর বেলায় মাছ ধরতে হবে।
উৎপাদন
বর্ণিত পদ্ধতিতে একর প্রতি মাছের উৎপাদন ৪-৫ টন পাওয়া সম্ভব।
সম্ভাব্য উৎপাদন ব্যয়, আয় ও মুনাফা (এলাকাভেদে ইজারা মূল্য ও উপকরণ মূল্যের পার্থক্যের জন্য ব্যয়, আয় ও মুনাফা কমবেশী হতে পারে) জলায়তন এক একর, সময়কালঃ ৮-৯ মাস
ব্যয়ের খাত | ব্যয় (টাকা) |
---|---|
ইজারামূল্য, পুকুর প্রস্তুতি, রোটেনন, চুন, সার ইত্যাদি থোকি | ৬০,০০০.০০ |
পোনা: বিভিন্ন মডেলের গড় থোক (মডেল ভেদে তারতম্য হবে) | ৬০,০০০.০০ |
খাবার: ৯০০০ কেজি X ৪০ টাকা(নিজস্ব খামারে উৎপাদিত) | ৩,৬০,০০০.০০ |
অন্যান্য (শ্রমিক, জালটানা, ঔষধপত্র,বাজারজাতকরণ): থোক | ১,০০,০০০.০০ |
জমানো টাকা | ৩৯,৩৭৫.০০ |
মোট ব্যয় | ৬,০৯,৩৭৫,০০ |
আয়ঃ উৎপাদন ৪৫০০ কেজি x ২২৫ টাকা প্রতি কেজি হারে = ১০,১২,৫০০/- টাকা
ব্যয়ঃ ৬,০৯,৩৭৫/-
মুনাফাঃ ১১০,১২,৫০০,০০- ৬,০৯৩৭৫.০০ = ৪,০৩,১২৫/-
উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলনের সাধারণ নিয়মাবলি সর্বক্ষেত্রে সঠিকভাবে মেনে একজন চাষি এ পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে পারবেন।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।